Skip to content

অর্থপূর্ণতার খোঁজে আরেক জীবন

গ্রাম থিয়েটার পত্রিকা – ৩৭ বর্ষ

আশ্বিন-কার্তিক ১৪২৬
OCTOBER 2019​

হাবিব জাকারিয়া উল্লাস
বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা সেলিমের জীবনাবসান ঘটেছে। হ্যাঁ আর একটি মানবজীবন সম্পূর্ণ বা পরিণত হয়েছে। এখন একটি সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে বলা যেতে পারে তাঁর সম্পর্কে, নির্লিপ্ততা বা প্রভাবিত আবেগ নিয়ে অথবা ব্যক্তিগত-অব্যক্তিগত ছেঁকে বা না ছেঁকেও। তবে এ ধরনের লেখা বেশ বিপজ্জনক। প্রসঙ্গ যখন মেহেরুন্নেসা তখন দৃষ্টিভঙ্গি লেখাটিকে বিভিন্ন অসমধর্মী ব্যাখ্যায় উপনীত করবার যথেষ্ট অবকাশ রাখে। এমতাবস্থায় ইতিবাচক অবস্থান হচ্ছে মেহেরুন্নেসা সেলিমের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তাঁকে দেখা। সেক্ষেত্রে একথা বলবার অপেক্ষা রাখেনা যে তাঁর জীবনদৃষ্টির সাপেক্ষে তিনি আদ্যন্ত অবিচল ও বহমান ছিলেন। আরও বলে রাখা জরুরি, আজ যে তিনি আমাদের আলোচ্য তার সাপেক্ষ নিঃসন্দেহে সেলিম আল দীন।

সেলিম আল দীনের সাপেক্ষে তিনি একজন আলোচ্য অস্তিত্ব এ নিয়ে বিতর্কের অর্থ হয় না। কেননা তিনি তাই চেয়েছিলেন, তাঁর মূল্যবোধ-অর্থপূর্ণতাবোধের সাথে সেই চাওয়ার নিবিড় যোগসূত্র নিঃসন্দেহে রয়েছে। কর্মজীবনে একটি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন তিনি, পাশাপাশি গার্হস্থ্য জীবন তো সকলেরই থাকে। শিক্ষক হিসেবে তিনি যে চতুর্পার্শ্বে আলোচিত ছিলেন একথা বলবার উপায় নেই, এমন কী খুব নিকটজনদের কাছেও ক্ষেত্রটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়নি। আবার সেলিম আল দীনের শিল্প-শিল্পতত্ত্ব-জীবনদর্শনের বলয়ে তাঁকে বেশ তৎপর ব্যক্তি হিসেবে শনাক্ত করবারও কোন পরিসর নেই। কেননা শিল্পের ক্ষেত্রে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনো সক্রিয়তা ছিলো না। এসব পরিপ্রেক্ষিত থেকে নিজেকে গুরুত্ববহ করে তুলবার তৎপরতাও তাঁর ভেতরে কখনও লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু সেলিম আল দীনের মৃত্যু পরবর্তীকালে উক্ত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই। সেলিম আল দীন সূত্রেই বাহিরের বিভিন্ন পরিস্থিতি-ক্ষেত্র ও প্রসঙ্গের সাথে তাঁকে সম্পৃক্ত হতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে বেশ কিছু লেখালেখিও আমরা পেয়েছি। যদিও সেটি তাঁর স্বভাবের মূলরেখা নয়। স্বভাবে তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী ও নির্জন।

সুতরাং সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়, দীর্ঘজীবনে মূলত পারিবারিক বৃত্তের বাহিরের মানুষের কাছে তিনি মনোযোগ কেড়েছেন পরিবারসূত্রেই, সেলিম আল দীনের সহধর্মী হিসেবে। এখানে সহধর্মী শব্দটি ভিন্নার্থে প্রযুক্ত, অর্থাৎ পারিবারিক পরিসরে একই জীবনদৃষ্টির প্রেক্ষিতে তাঁরা সারাজীবন সহাবস্থান করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করতেন। অথচ নারী হিসেবে বাংলাদেশের যে সময়পর্বে তিনি উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন তাকে খুব সাধারণ চোখে দেখবার উপায় নেই। স্বভাবতই কলেজ শিক্ষক বাবার উদার দৃষ্টিভঙ্গি উক্ত পরিসর সৃষ্টি করেছিলো। এই যোগ্যতা নিয়ে একক অস্তিত্ব হিসেবে বড় কোনো লক্ষ্যের পথে আত্মপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ তিনি সারাজীবনেই নেননি। বিষয়টি যে তাঁকে জীবনের কোন পর্যায়ে আত্মগ্লানিতে ফেলেছিলো তেমনটিও জানা যায় না। পারিবারিক জীবন নিয়েই বেশ আত্মতৃপ্ত ছিলেন তিনি আজীবন। ফলে পরিবারের বৃত্তেই মনোযোগ দিতে হয় মেহেরুন্নেসাকে জানতে বা বুঝতে। উল্লেখ্য যে, এই পরিবার সেটেলড নয় বরং দীর্ঘ প্রেমের ফসল। সেই প্রেমের ইতিবৃত্ত তিনি নিজেই স্মৃতিচারণ করে গেছেন পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু লেখায়। করোটিয়া কলেজে এক তরুণ লেখকের প্রতি যখন তিনি প্রেমানুভব করেন তখন সত্যিই প্রতিষ্ঠা-বিত্ত এসব হিসেব-নিকেশ সক্রিয় থাকলে সম্পর্কটি দানা বেঁধে উঠবার কোন কারণ ছিলো না। কেননা তখনকার সেলিম আল দীনের ভেতরে লেখক হবার সম্ভাবনা থাকলেও পরবর্তীকালের অন্য প্রতিষ্ঠাগুলোর লক্ষণ খুঁজে পাবার কোন কারণ নেই। তাই যে প্রেমে দুজন আবদ্ধ হন তা পুরোদস্তুর হৃদয়ঘটিতই। পরবর্তীকালে প্রচলের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সমাজের নারী হিসেবে নিজস্ব যোগ্যতা ও পরিবারের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মরত অপ্রতিষ্ঠিত নিম্নমধ্যবিত্ত দশার সেলিম আল দীনকে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত তাই প্রমাণ করে। প্রতিষ্ঠিত লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম আল দীন তার পরের ঘটনা। যে ঘটনাগুলো লেখক সেলিম আল দীনের জীবনে সার্থক পরিপূরক প্রেক্ষিত হিসেবে সক্রিয় ছিলো। এমন কী সহধর্মী হিসেবে মেহেরুন্নেসাকে নির্বাচন তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সফল সিদ্ধান্তের একটি। এককথায় সেলিম আল দীন তাঁর আত্মবিকাশের নিমিত্ত যথোপযুক্ত এবং পরিপূরক পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণে যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।

উত্তরকালে সেলিম আল দীন সেলিম আল দীন হয়ে উঠলেন, বিকশিত হলেন এবং সম্ভাব্য সকল পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় এলেন। এই হয়ে উঠবার সবথেকে ঘনিষ্ঠতম পর্যবেক্ষক মেহেরুন্নেসা এবং তিনি স্বভাবতই পূর্বের অবস্থানে রইলেন। ফলে পরিবারের ছোট্ট পরিসরে সেলিম আল দীনের মত ব্যক্তিত্বের আড়ালে থেকে সর্বজনের মনোযোগ আকর্ষন দূরহই বটে। কিন্তু তিনি একেবারে তাঁর নিজস্ব অবস্থানে থেকেই সেটি পেরেছিলেন। তাঁর নিজস্ব জীবনকৃত্যের যে ধরন বা বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস ও ধরনের যে তাৎপর্যপূর্ণ অপরিহার্যতা রয়েছে তা তিনি বাস্তবসত্যে চাক্ষুস করতে পেরেছিলেন। সেক্ষেত্রে সেলিম আল দীনের ভূমিকা রয়েছে। মেহেরুন্নেসা যে তাঁর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এসত্য আড়াল করবার কোন প্রয়োজনীয়তা তিনি কখনই বোধ করেননি। সত্য কথা এই যে সেলিম আল দীন জীবনের সবথেকে দীর্ঘতম সময় বোধ করা যায় বাসাতেই কাটিয়েছেন, আর বাসায় সেলিম আল দীনের থেকে মেহেরুন্নেসা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন নানা কারণে।

উল্লেখ্য যে, সেলিম আল দীনের বেশিরভাগ লেখা-গবেষণা স্থানিকভাবে তাঁর বাসার ডাইনিং টেবিল থেকে বেরিয়ে আসা। অন্তত এই লেখার লেখকের অভিজ্ঞতা যতখানি। সচরাচর যেমনটি ঘটে সকলের, লেখার বিশেষ কক্ষ বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগের ব্যক্তিগত কক্ষ, এসব সেলিম আর দীনের ক্ষেত্রে কোন অপরিহার্যতা তৈরি করতে পারেনি। ড্রয়িং-ডাইনিং মিলিয়ে কেটেছে তাঁর কাজ-বিনোদন মিলিয়ে সিংহভাগ সময়। ড্রয়িংরুম ছিলো বিনোদনের কেন্দ্র এবং ধরনটা আড্ডা। বিশ্ববিদ্যালয় যেমন বছরে বছরে নতুন প্রজন্মেকে আত্মীকরণ করে আর পুরাতন প্রজন্মকে বিদায় দিয়ে নিরন্তর বহমান, সেলিম আল দীনের ড্রয়িংরুমও বরাবর তার সাথে সঙ্গত দিয়ে বহমান। সেই আড্ডার কোনো সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলা ছিলো না। দিনের পর দিন, সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি চলছে এবং চলছে, সাথে প্রাতরাশ-মধ্যাহ্নভোজ বা রাতের খাবার। সেখানে স্থায়ী সদস্য বিরল, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পমনস্ক তরুণরা সভ্য। এ তাঁর পঞ্চাশ ও পঞ্চাশোর্ধ কালের বাস্তবতা। শোনা যায় রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাথে, হুমায়ূন ফরিদীর সাথে তাঁর আড্ডার স্মৃতি। এর বাহিরে তো গ্রাম থিয়েটার সংশ্লিষ্ট অনেকেই নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। এ লেখার লেখক দেখেছেন দেবেশ রায়, অরুণ সেন ও হাসান আজিজুল হককে। তার মাঝে সেলিম আল দীন ও মেহেরুন্নেসা তাঁদের সকল জীবনকৃত্য সারছেন। মোটকথা একধরনের উৎসবমুখর জীবন। কথাটা বলা যত সহজ হচ্ছে প্রায়োগিক জীবনে তার বাস্তবায়ন ততটা সহজ নয়। কেননা পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের সাথে ব্যক্তিগত, দরজা-জানালা-ভেন্টিলেটর এই প্রশ্নগুলো নিবিড়ভাবে জড়ানো। সেই প্রেক্ষিতে মেহেরুন্নেসার পরিবার ছিল অসংখ্য ব্যক্তিগততে নীরব পরিবারের মাঝে সর্বোচ্চরকমের মুক্ত একটি পরিবার। ব্যক্তিগত নিয়ে সেখানে কোন বিপত্তি বা টানাপড়েন ছিলো না। এই মুক্ত পরিসর সেলিম আল দীন একা সৃষ্টি করেছেন এমনটি কোনভাবেই বলবার চেষ্টা করা উচিৎ নয়। একা তা সম্ভব নয় এবং সেখানেই মেহেরুন্নেসা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দেন। তিনি পারিবারিক নারী হিসেবে একেবারেই প্রথার বাহিরে অবস্থান করতেন। তাঁর বয়স যে কোঠাতেই পৌঁছুক না কেন তিনি সাকলের ভাবি ছিলেন, যাঁর মন ও আচরণের মাঝে ফারাক খুঁজতে যাবার থেকে বড় বোকামি আর হয় না। নতুন মানুষকে উষ্ণতায় বরণ, ঘনিষ্ঠতায় নেয়া, ক্রমশ আত্মীয় করে তোলা, এমন কী আন্তরিক মতবিনিময়ের সূত্রপাত এসব মিলিয়ে সেখানে এক সুস্থির ভিন্ন সংস্কৃতি রয়েছে। অর্থাৎ প্রচলের জটিলতামুক্ত একটা সহজ পরিসর। যে সংস্কৃতি যৌথতার, বিচ্ছিন্নতার নয় এবং দুজনে মিলেই সে সংস্কৃতিতে বিশ্বাস রেখেছেন, প্রয়োগে সফলও হয়েছেন। এই পরিসর নিয়ে ভিন্ন আলাপের অবতারণাও ঘটানো যেতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই পরিবার ছিলো নিঃসন্তান। সন্তানহীনতা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু তাঁরা সদ্যজন্মা এক পুত্রসন্তানকে হারান। ফলে পরিবারটির পক্ষে আর প্রথাগত পারিবারিক ছকে-লক্ষ্যে অগ্রসর হবার উপায় বা কারণ থাকে না। কিন্তু উক্ত বিপর্যয়কে একটি ইতিবাচক ধারায় বাহিত করা কেবল তাঁদের মত ব্যক্তিত্বের পক্ষেই সম্ভব। সেলিম আল দীনের গৃহকেন্দ্রিক যাপন কিংবা উভয়ের এই পরিসর সৃষ্টির পেছনে দুজনের উৎসবমুখর বেঁচে থাকবার প্রসঙ্গটি সক্রিয় ছিলো, এমত ভাবনাকে অমূলক ভাবা দুরূহ। নিঃসন্দেহে অন্তর্গতভাবে দুজন এক অদ্বৈত মানসিক যোগসূত্রেই জীবনযাপন করেছেন।

তবে পরিবারের পরিসরেও কখনই নিজেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবার প্রবণতা মেহেরুন্নেসার ছিলো না। একাধারে সেলিম আল দীনকে গুরুত্ব দেয়া এবং প্রকাশ্যে কঠোর সমালোচনার মধ্য দিয়ে নিজের অবস্থান যথেষ্ট স্বচ্ছ রাখতে পারতেন তিনি। এও এক ব্যতিক্রম সংস্কৃতি। যেখানে দুটি মানুষ এত তীব্র ব্যক্তিত্ব যে ব্যক্তিত্ব নিয়ে তাঁদের কোনো অহেতুক টানাপড়েন ছিলো না। কঠোর সমালোচনার দিকটিতেও বেশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতো যে তিনি সেলিম আল দীনের সর্বোচ্চসম্ভব শুভাকাক্সক্ষী। যে শুভাকাক্সক্ষা শিল্পী সেলিম আল দীনের যথাযথ বিকাশকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিবেচনা করে। প্রকৃতপক্ষেই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা-ভাবনা-স্বপ্ন-পরিকল্পনা সবকিছুর মূলেই ছিলেন সেলিম আল দীন। সেলিম আল দীন সৃষ্টি করবেন আর তার জন্য সমস্ত অনুকুল পরিবেশ-পরিস্থিতি নিজের সম্ভাব্যতার মাঝে সর্বোচ্চভাবে ঠিক রাখবার চেষ্টা করবেন মেহেরুন্নেসা, সেটিই যেন অনিবার্য। এই বোঝাপড়ার নিঃসন্দেহে একটি মানদণ্ড ছিলো, গন্তব্য ছিলো, যা কেবল তাঁরা দুজনেই জানতেন। কঠোর সমালোচনার ধরন থেকে সেই মানদণ্ড সম্পর্কে আন্দাজ করা সম্ভব। শিল্পের প্রতি মগ্ন দায়বদ্ধতা, ক্রম উত্তরণই বোধ করা যায় সেই মানদণ্ড। এটি আরও জরুরি হয়ে উঠেছিলো নব্বই দশকে টেলিভিশনের ব্যাপক প্রসারের কালে। কেননা বাণিজ্যিকভাবে টেলিভিশন নাটক লিখবার একটি ব্যাপক অবকাশ তখন সৃষ্টি হয়। সেই স্রোত যেন সেলিম আল দীনের শিল্পমগ্নতায় হানা না দেয় এ ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর থাকবার চেষ্টা করতেন তিনি। বৈষয়িকতা যেন সেলিম আল দীনকে মোহগ্রস্ত না করে সে ব্যাপারেও তাঁর ভাবনার অন্ত ছিলো না। তিনি চাইতেন মঞ্চনাটক, একেকটি আত্মঅতিক্রমী সৃষ্টি আর টেলিভিশনের জন্য কেবল দৃষ্টান্তস্থাপনকারী নাটক। ফলে সুস্পষ্ট হওয়া যায় বিষয়বাসনারহিত একধরনের তীব্র আদর্শবাদ তিনি লালন করতেন। যার বাহ্যরূপটা শিল্পের জন্য আত্মনিবেদিত এক যুগল সন্ন্যাস যাপনের সমরূপ, পরিবারকে যৌথতার প্রশয়ে আশ্রম সমতুল্য করে তুলবার উদ্যোগেও উক্ত ভাবনার ছায়াসম্পাত দেখা যায়। উপরিউক্ত বক্তব্যের সমর্থন মেলে সেলিম আল দীনের আত্মজীবনী দিনলিপি’তে। যেখানে আত্মসমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি আকাক্সক্ষা ও বাস্তবতার ফারাকে আত্মগ্লানির দিকগুলো নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেছেন। উক্ত দিকগুলোর সাথে মেহেরুন্নেসার সতকর্তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় অনায়াসেই। উল্লেখ্য যে, সেলিম আর দীনের ভাষ্য থেকেই জানা যায় এই দিনলিপি লিখাবার উদ্যোগটিও মেহেরুন্নেসারই। ব্যক্তি সেলিম আল দীনকে জানতে নিঃসন্দেহে এই গ্রন্থের বিকল্প নেই।

প্রকৃতপক্ষেই বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে মেহেরুন্নেসার ব্যক্তিগত জীবন ছিলো চূড়ান্তরকম ভোগাসক্তিমুক্ত, পরিমিত। হয়তো একটি সময় দুজনেই এমন যাপন আশা করেছিলেন। কিন্তু সেলিম আল দীন কোন সুস্থির কাঠামোয় বদ্ধ থাকবার মানুষ নন। মেহেরুন্নেসা সেটি পেরেছিলেন, এমনকি পারিবারিক যন্ত্রযান ব্যবহারেও তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। ব্যক্তিগত কক্ষের পরিবেশ, পোশাকের রুচি, খাবার, মানুষের সাথে সংযুক্তি, বাসার আসবাবপত্র সব মিলিয়ে এক নান্দনিক পরিমিতিবোধ বেশ সাংগীতিক সুবাতাস বইয়ে রাখতো ঘরগুলোতে। তবে বলা হয়েছে, সেলিম আল দীন চূড়ান্ত রকমের ভাঙনমুখা মানুষ এবং সে ভাঙনের গতিপ্রকৃতি একদিকে দার্শনিক, আরেকদিকে শিশুসুলভ, যুক্তিতে তার নিষ্পত্তি ঘটানো দুরূহ। যুগল সঙ্গের জন্য এ এক বড় বিপত্তি। কেননা স্থিরতার প্রশান্তি সেখানে নেই, প্রতিনিয়ত অভিযোজনের যন্ত্রণা আছে, তার উপরে শেকড়-বাকড় ঠিক রাখবার অপরিহার্যতা রয়েছে। মেহেরুন্নেসা সেটি পেরেছিলেন বেশ সফলভাবে এবং দায়বোধ করেছিলেন-চেয়েছিলেন বলেই পেরেছিলেন। তাই শেষজীবনঅবধি নিরন্তর অভিযোজনের যন্ত্রণা নির্বিঘ্নে আত্মীকরণ করতে দেখা যায় তাঁকে। সেখানেও কারণের রহস্য নিঃসন্দেহে দুজনের যোগসূত্রের শেকড়ে নিহিত। ফলে ঢের বাজার ও রসনাবিলাসকে তিনি কেন অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন এবং এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কষ্টও মাথা পেতে নিতে আপত্তি করতেন না। আবার অন্যান্য বস্তুগত আকাঙ্ক্ষাগুলোর প্রতি তীব্র অনীহা কেন প্রকাশ করতেন তার সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। একথা বলাও জরুরি যে, নিকটজনরা স্পষ্টতই জানেন মুখে স্বীকার না করলেও কার্যত সেলিম আল দীনের কাছে মেহেরুন্নেসার কঠোর অবস্থানের গুরুত্ব ছিলো।

গভীর প্রযত্ন ভালোবাসার অপরিহার্য অংশ সন্দেহ নেই। সকলের ক্ষেত্রেই সুস্বাস্থ্য-দীর্ঘজীবন কামনা-নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন এসব নিয়ে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দেখা যায়। কিন্তু বোনের কন্যা অন্বিতা জন্মাবার পূর্ব পর্যন্ত সেলিম আল দীনের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় মাতৃসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিটি বেশ তীব্রমাত্রাতেই ছিলো। সেক্ষেত্রে সেলিম আল দীনেরও তাঁকে স্বস্তিতে রাখার ইচ্ছা ছিলো না। এ ব্যাপারটিকে ইতিবাচকভাবে দেখাই শ্রেয়। কেননা মেহেরুন্নেসা মানসিকভাবে ব্যস্ত না থাকলে তাঁর নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্নতায় চলে যাবার অবকাশ তো থাকেই। ভাবতে অবাক লাগে সেলিম আল দীনের তরুণ অবস্থা থেকে শুরু করে মৃত্যুঅবধি সমস্ত লেখার মূলকপি তাঁর সযত্ন সংগ্রহে ছিলো, এমন কী একটি ছেঁড়া পৃষ্ঠা পর্যন্ত। উপরন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিটি সংবাদ ও সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা। এ কাজটি তিনি যে প্রযত্ন ও গুরুত্বের সাথে করতেন তাতে একজন লেখক সহধর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা-দায়িত্ববোধের উচ্চতা অনুধাবনে আর অন্যকোথাও কিছু হাতড়াতে হয় না। আশা করা যায় সেলিম আল দীনকেন্দ্রিক গবেষণায় মেহেরুন্নেসার উক্ত উদ্যোগের তাৎপর্য গবেষকরা তীব্রভাবেই অনুভব করবেন। ব্যক্তি সেলিম আল দীন যাই করুন না কেন, শিল্পী হিসেবে তিনি যে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ কিছু করে চলেছেন এ ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয় ছিলো না। কেননা উক্ত কর্মযজ্ঞ অনুধাবনের মতো নন্দনবোধ ও দার্শনিক উচ্চতা তিনি লালন করতেন। আর তা দুজনের গভীর মানস সংযোগ ব্যতিরেকে অসম্ভব। ঠিক সেখানেই তিনি নিজেকে সেলিম আল দীনের গোটা সাফল্যের উল্লেখযোগ্য অংশীদার বিবেচনা করতেন, সেটিই ছিলো মানুষ হিসেবে তাঁর পরিতৃপ্তির মূল ক্ষেত্র, জীবনের অর্থপূর্ণতা উপলব্ধির প্রধানতম পরিসর। তা না হলে ক্রমাগত লিখে যাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বতন্ত্র নাটক বিষয়ক বিভাগ প্রতিষ্ঠা, গ্রাম থিয়েটার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর ভ্রমণ-জনসংযোগ, ঢাকা থিয়েটারের সাথে সংযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিসর নিয়ে ভাবনা ইত্যাদির মধ্যে ক্রমাগত সংযুক্ত সেলিম আল দীনের সাথে বসবাস দুরূহই বটে। এসবকিছুকেই বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর উপলব্ধি করতে হয়েছে, আত্মিকভাবে গ্রহণ করতে হয়েছে, অভিযোজন করতে হয়েছে। তবে তা নিজের দিক থেকেই, কোন প্রকার যন্ত্রণা দেয়া বা নেয়া ছাড়া। কারণ তিনি বুঝতেন, বেশ স্পষ্ট করেই বুঝতেন সেলিম আল দীনের বেরিয়ে আসাটা তাঁর এবং সকলের প্রয়োজন, স্বার্থটা বৃহত্তর। ফলে তাঁর ও তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন একপর্যায়ে সমগ্রমানবের জন্য উৎসর্গিত হয়। উক্ত উৎসর্গ বেশ স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে যে সেলিম আল দীনের রচনা ও দার্শনিক বিবর্তনের অন্তর্গত অভিযাত্রার সাথে তিনিও পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটেছেন। বলতে গেলে তিনি সেলিম আল দীনের সৃষ্টি ও ভাবনার প্রথম পাঠক। সেক্ষেত্রে লেখা বা নব উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের দুজনের ভাববিনিময়ের প্রসঙ্গে অবহিত হবার অবকাশ নেই। কিন্তু অনুধাবন-উপলব্ধি না করলে ক্রমাগত সমর্থন করে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। এই জীবনস্রোতের মাঝে একটা আকস্মিক জোয়ার নিয়ে এসেছিলো অন্বিতা। মেহেরুন্নেসার ভগ্নীকন্যা। জীবনের উৎসবে ভিন্ন রঙ লেগেছিলো, আশ্রমে বেজে উঠেছিলো নবপ্রাণযজ্ঞের গীত। কিন্তু সে এক ক্ষণস্থায়ী পরিস্থিতি। দুরারোগ্য ক্যান্সার নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকা অন্বিতা সবাইকে আবারও ভয়ঙ্কর এক সত্যে পৌঁছে দিলো, তার নাম মৃত্যু। মৃত্যু যেন তাঁদের বারবার শেখায় কোন মায়া-মোহ নয়। মেহেরুন্নেসা তাঁর সর্বসামর্থ্যে শেষদিন পর্যন্ত অন্বিতার বেঁচে থাকবার লড়াইয়ের পাশে ছিলেন। কিন্তু তারই মাঝে আকস্মিকভাবে চলে গেলেন সেলিম আল দীন, কিছুদিনের মাঝেই অন্বিতা। ততদিনে বারান্দার লতাফুলগুলো থেকে সবুজ লাবণ্য ঝড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। একটা ভয়াবহতম শূন্যতা চারিপাশে।

মেহেরুন্নেসা সামলে নিয়েছিলেন। একটা গোছানো সম্পূর্ণ ও অর্থপূর্ণ পরিণতিতে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি আঁকড়ে ধরলেন নিজের সাজানো থরে থরে জীবন্ত অক্ষরে ঠাসা সেলিম আল দীনকে। অনেক পরিকল্পনা, অনেক অভিজ্ঞতা, সুখকর-বেদনার। রচনাবলীর শেষ খণ্ডগুলো, অপ্রকাশিত রচনা, চিঠিপত্র অনেক কাজ করবার কথা। তারপর একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ, রক্ষিত স্মৃতিগুলোর একটি নিরাপদ আশ্রয়। নাহ্… গোছানোমতো হলো না কিছুই। আকস্মিক চলে যেতে হলো তাঁকেও। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত জীবনকে তিনি অর্থপূর্ণ ভেবেছেন, সফল ভেবেছেন। তাঁকে স্মরণ করতে হচ্ছে-হবেও, সেই অর্থপূর্ণতার কারণেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.