Skip to content

একজন পারুল ও শতপুত্রের জননী

গ্রাম থিয়েটার পত্রিকা – ৩৭ বর্ষ

আশ্বিন-কার্তিক ১৪২৬
OCTOBER 2019​

কৃপাকনা
নিঃসন্তান পারুলের কোনো সন্তান না থাকলেও তিনি ছিলেন শতপুত্রের জননী। কত অগণিত সন্তান তাঁর ছড়িয়ে আছে সারা দেশজুড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা থিয়েটার কিংবা বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার; কোথায় নেই তাঁর সন্তানেরা। খুব সহজেই সবাইকে নিজের সন্তান করে নিতেন। কত মানুষ যে তাঁকে মা বলে ডাকতো তার শেষ নেই। তাঁর এই অসংখ্য সন্তানের মধ্যে আমি একজন। পারুল আমার বড়খালা। বড় খালার সাথে আমার প্রথম যে স্মৃতিটার কথা মনে পড়ে তা হল বড়খালু আদর করতে গিয়ে আমার গালে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল আর আমি বড়খালার কোলে বসে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। সময়টা কত সালের ঠিক মনে নেই, কিন্তু আমি তখন স্কুলে ভর্তি হইনি। সম্ভবত বয়স চার কী পাঁচ হবে। আমি ওনার নিজ পরিবারের সদস্য হওয়াতে অন্যদের থেকে একটু বেশিই হয়তো তাঁর মাতৃস্নেহের আঁচলে থাকতে পেরেছি। আমার কিংবা আমাদের পরিবারের সব ভাইবোনদের ঠিক কবে থেকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় মনে নেই। কিন্তু পারুল মা-এর কারণেই যে বই পড়াটা আমাদের মধ্যে ঢুকে গেছে এটা নিশ্চিত। সেই ছোটবেলা থেকেই বড়খালা যখনই ঢাকা আসতো সাথে করে আমাদের জন্য অনেক অনেক বই নিয়ে আসতো। সেই ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে যখন আমাদের শৈশবের দিনগুলোতে ফেইসবুক বা ইন্টারনেট কোনোকিছু ছিলো না তখন আমরা সারাবছর বড়খালার পাঠানো বইগুলোর জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। বড়খালার হাত ধরেই আমাদের বাহিরের বইয়ের সাথে পরিচয়। আমরা সারাবছর অপেক্ষা করতাম একুশে বইমেলার জন্য। বড়খালু আর খালা মিলে আমাদের সব পিচ্চিদের নিয়ে যেতেন বইমেলায় আর গাড়ির পেছন ভর্তি করে আমরা বই নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। ওই বইগুলোই তখন হত আমাদের পরবর্তী এক বছরের বিনোদন আর অবসরের সঙ্গী।

বড় খালার একটা অদ্ভুত নেশা ছিল পেপারকাটিং করার। সারাবছর ধরে আমাদের জন্য পেপার থেকে শিক্ষার পাতাটা কেটে রেখে দিতেন। আমার কাজিনদের মধ্যে কেউ ক্লাস ৫ এর বৃত্তি পরীক্ষা দেবে, কেউ ক্লাস ১০ এ এসএসসি। সবার জন্যই তিনি আলাদা আলাদা করে পেপারকাটিং জমাতেন। আর ঈদে যখন ঢাকা আসতেন ঈদ করতে তখন ব্যাগভর্তি করে সেই পেপারকার্টিং নিয়ে আসতেন সবার জন্য। একবার তো আমার ক্লাস ৬ এর একটা বাংলা ২ পাতার নোট জাহাঙ্গীরনগর থেকে নিজে সাভারে এসে কুরিয়ার করেছিলেন যাতে করে আমি পরীক্ষার হলে যাবার আগে অন্তত একবার হলেও তা পড়ে যেতে পারি। এমনি ছিলেন আমাদের পারুল মা। বাংলার শিক্ষক হবার কারণে আমাদের সবারই ব্যাকরণের হাতেখড়ি তাঁর কাছ থেকেই। কী আসাধারণ ভাবে বুঝিয়ে দিতেন এত কঠিন কঠিন সব সমাস কিংবা কারক। ঈদে ঢাকা এলেই আমাদের নিয়ে দল বেঁধে ব্যাকরণ বুঝাতে বসতেন। ১৯৯৭ সালের দিকে হঠাৎ করেই বেলপালসিতে আক্রান্ত হয়ে বড়খালা প্রায় ৩ মাস ফিজিও থেরাপি নেয় ঢাকায় থেকে। তখন আমাদের বাসায় পাশেই হসপিটাল থাকার কারণে ৩ মাস আমাদের বাসাতেই থেকেছে। ইস, আমার যে তখন কী আনন্দ! কারণ আমি সারাদিনই তখন বড়খালাকে কাছে পাচ্ছি। সদ্য ক্লাস ওয়ান এ পড়া আমার নতুন স্কুলের সব গল্প বলার মত একটা মানুষ পেয়েছি। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে আমি বড়খালাকেই আমার ছাত্র বানতে শুরু করলাম। আর আমি স্বয়ং স্কুলশিক্ষককের ভূমিকায়। তারপর স্টিলের আলমারির গায়ে চক দিয়ে লিখে বানাতে হত ব্ল্যাকবোর্ড। আর প্রতিদিন আমি স্কুলে যা যা শিখে আসতাম তাই বাসায় ফিরে ছাত্রীরূপী পারুল মা কে শিখানো শুরু করতাম। আহা কী আনন্দের সেই দিনগুলো। আমাদের যেকোন রেজাল্ট এ সব থেকে বেশি খুশি হতো সে। সবসময় নিজের সবটুকু দিয়ে আমাদের ভালোবাসতো। সব সময় বলতো আমি তোদের সবার মা।

সেদিনের সেই ছোট্ট আমি কলেজের পাট চুকিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাও আবার নাট্যকলা বিভাগে। এক্ষেত্রেও বড়খালাই একমাত্র ভরসা। ভর্তির দিন ভাইবা দেয়ায় সময় শিক্ষকেরা যখন বললেন তোমার তো রেজাল্ট অনেক ভালো আর তুমি তো সাইন্স থেকে এসেছো। তোমার ফ্যামিলি কি নাট্যকলায় তোমায় পড়তে দেবে? যাও বাহিরে গিয়ে তোমার মাকে ফোন দিয়ে সিওর হয়ে আসো। আমি রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেই ফোন দিলাম বড়খালাকে। একমাত্র তাঁর একটা কথাতেই নাট্যকলায় ভর্তি হয়ে গেলাম নির্দ্বিধায়। সেই আমিই যখন অর্নাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলাম সবার আগে আমি ফোন করলাম বড়খালাকেই। কারণ এই অবদানের সবচেয়ে বড় অংশীদার তো বড়খালাই। আহ কী যে আনন্দ তার! নাটকের সাথে যুক্ত হওয়া আমার এই জীবনে যখনই যে বই এর দরকার হয়েছে আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেছি তার কাছে। নাটক বিষয়ে যেকোন কিছুর জন্য আমার ভরসাই বড়খালা। কত জানা অজানা বই নিয়ে এসেছে জাহাঙ্গীরনগর থেকে। আমার বিভাগে একটা কথা রটে গিয়েছিল, নাটক বিষয়ে পৃথিবীর যেকোনো বই নাকি একমাত্র পাওয়া যায় আমার কাছেই। হুম সত্যিই তো। যাবেই বা না কেন? সবার পেছনে তো আর একজন পারুল থাকে না। যেখানে যে লেখা পেতেন নাটক নিয়ে কেটে রাখতেন আমার জন্য। কোনো একটা কাগজে হয়তো বড়খালুর হাতে লেখা নাটকের কিছু একটা পেয়েছে আমি জাহাঙ্গীরনগর গেলে সেটাও বের করে বলতেন ‘দেখ তো তোর কোনো কাজে লাগবে কি না।’ তখন সেই এক টুকরো কাগজ আমার না লাগলেও এখন আমার লাগে বড়খালা। এখন যখন ঈদের দিন আমরা আর তোমার হাত থেকে সালামি নিতে পারি না তখন বুকের মধ্যে কোথাও একটা লাগে, যখন জাহাঙ্গীরনগরের ক্যাম্পাসে গেলে তোমার ঘরের বন্ধ দরজাটা দেখি তখনও বুকের মধ্যে লাগে বড়খালা। তোমার দেয়া নাটকের প্রত্যেকটা বই এর দিকে চোখ গেলেই লাগে বুকের মধ্যে। তুমি যখন আমাকে অনেক বই পাঠাতে, নোট পাঠাতে তখন আমার বন্ধুরা সব সময় বলতো ইশ! তোর মত এমন একটা পারুল মা যদি আমাদের থাকতো। আমি বলতাম এমন পারুল মা পাবার জন্য কপাল লাগে এমন পারুল মা সবার কপালে জোটে না…

Leave a Reply

Your email address will not be published.