[১৪ জানুয়ারি ২০২১- ‘দৈনিক ফেনী’ পত্রিকায় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকে নিয়ে প্রকাশিত পিয়াস মজিদ এর প্রবন্ধটি পাঠকদের জন্য গ্রাম থিয়েটার ওয়েব পোর্টালে পুণঃপ্রকাশ করা হলো।]
পিয়াস মজিদ
সেলিম আল দীন আমার শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক না কিন্তু ‘স্যার’ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষণে তাঁকে ডাকতে পারিনা। এই সমীহ ও শ্রদ্ধা সহজাত; জেরপূর্বক আদায় করা না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই পড়েছি তাঁর নাটক ‘প্রাচ্য’। সেই রচনার শেষ পঙক্তি পড়ে তাঁকে মনে হয়েছিল গান্ধীবাদী ‘ হত্যা ভুলে যায় তারা’। ক্রমে কাছ থেকে দেখে, কথা শুনে, মঞ্চে তাঁর নাটক দেখে আর একটু গভীরে পাঠ নিয়ে বুঝেছি তিনি আসলে সেলিম আল দীন-বাদী। কোনো বিদ্যমানের দাসবৃত্তি মানতে পারগ ছিলেননা বলেই তো ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ত্ব’, ‘বর্ণনামূলক নাট্যগুচ্ছ’। ক্যাম্পাসে তাঁর সঙ্গে প্রথম মোলাকাত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেন্দ্র আয়োজিত ‘আমাদের রাষ্ট্রের ধারণা’ শীর্ষক বক্তৃতানুষ্ঠানে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে তিনি খুব মূল্য দিয়েছেন-মনে আছে। তারপর প্রভাতী বা বৈকালিক হাঁটার পথিকপ্রাণকে একটু নিবিড় করে পাওয়া পরাগ রিছিল, দুপুর মিত্রসহ আরও দু’একজন অগ্রজ কবিসমেত তাঁর বাসায় প্রকাশিতব্য লিটলম্যাগের জন্য কবিতা চাইতে গিয়ে। তাঁর ‘ডিম’ কবিতা পড়েছি কিনা জানতে চাইলেন। আমি সে কবিতার নামও শুনিনি তবে এই তথ্যের সঙ্গে এও জানালাম তাঁর নাটকেই তো পাই কবিতার স্বাদ। নাটক সবাই দেখে, পড়েনা কেউ খুব একটা- এমন হতাশার কথা বললেন। আমি একজন নাট্যলেখকের সঙ্গে পরবর্তী আলাপের অপেক্ষায় পড়লাম ‘একটি মারমা রূপকথা’, ‘হাত হদাই’। আচ্ছন্ন করে রাখল শেষোক্ত নাটকের ভূমিকাংশের বাক্যবিভা:
‘বেহিসেবি নাবিকের বেপরোয়া জীবন থেকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে কয়েকটি ওডেসি।’
ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে দেখলাম ‘শকুন্তলা’। স্বল্ল সংলাপ আর দীর্ঘ বর্ণনার সৌন্দর্যসংহতিতে গ্রীক অ্যাম্ফি থিয়েটারের আদলে গড়া মুক্তমঞ্চ তার সীমা ছাপিয়ে আমার দৃষ্টিসীমায় তৈরি করে অসীমের স্পন্দ, এক হয়ে যায় জাহাঙ্গীরনগরের ঘাস আর মহাভারতের মাঠ।
পুরনো কলাভবনে সেলিম স্যারের একদা নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ ছিল নিচতলায় আর আমার পাঠ-বিভাগ ইতিহাস দ্বিতীয়তলায়। কালেভদ্রে যেতাম তাঁর কক্ষে। নতুন কবিতা শুনতে চাইতেন। একদিন ‘দুর্দশার ঋতু’ নামে একটি কবিতা শোনালাম, মধ্যপ্রাচ্যে ঘনায়মান দুর্দশা প্রসঙ্গকে ‘শ্যাওলার হাড়’, ‘শামুকের ধড়’ নামে উপমায়িত করার বিষয়টি তাঁর মনোযোগ পেয়েছিল-একথা ভাবতেই নিজের কবিজন্মের সার্থকতা খুঁজে পেতে থাকি। কলাভবন থেকেই তাঁর সঙ্গে একসন্ধ্যার পদ-ভ্রমণে জানতে চাইছিলেন কী পড়ছি। তথ্যমূলক দুটো বইয়ের কথা বলতেই বিরক্ত হয়ে বললেন ‘তথ্য আর সিদ্ধান্ত পড়বি কেন? বিস্ময় আর কুহক পড়া হল কবির কাজ।’ ওই যে ‘তুই’ বলে অনায়াস-অধিকারে বাঁধলেন, এখনও বই পড়ার আগে নির্বাচনের সময় সে অধিকারী-কণ্ঠের কথা মনে আসে।
চারুকলার বকুলতলায় ২০০৪ সালে, কবি শামসুর রাহমানের ৭৫ জয়ন্তীতে তাঁকে নিবেদন করে লেখা সেলিম আল দীনের মানপত্র-মতোন ছোট্ট লেখাটায় ছিল ‘জীবনঝড়ের ক্ষুব্ধ ঘূর্ণি উড়িয়ে আপনিই তো সেই অবাক বাংলাদেশ’। আবার এক আলাপনে উষ্মা প্রকাশ করে বললেন “জানিস, এতবড় কবি। আমার নাটককে একদিন বললেন ‘গ্রামনাটক’। পল্লীপ্রসঙ্গ থাকলেই গ্রামনাটক?”
বুঝলাম অবিচল অন্ধতা তাঁর রাস্তা না। কবি ফেরদৌস মাহমুদের অনুরোধে বইপড়া, লেখা বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তাঁর। হাতের কাছে সবসময় কী বই রাখেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন ‘ পবিত্র কোরান শরিফ ও পবিত্র গীতবিতান।’ এমনই ছিল তাঁর অন্তর্গত বিশ্বাস ও অভিব্যক্তির দৃঢ়তা যা নিস্তরঙ্গ সাহিত্যসমাজে চমক জাগানোর বেশি তাঁকে ভুল বুঝতে সহায়ক হতো। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলতেন ‘রবীন্দ্র মহাভুবন’; তিনি না বললে আমার খেয়ালই হতোনা রফিক আজাদের প্রথম বইয়ের নাম রবীন্দ্র-বাহিত ‘অসম্ভবের পায়ে।’ ‘ এক ঘর মে দু পীর’ এর মতো বললে এক ক্যাম্পাসের দুই খ্যাতনামা সাহিত্যিক মোহাম্মদ রফিক ও সেলিম আল দীন বসত করতেন আমাদের সমকালে। একসঙ্গে মঞ্চে কোনো অনুষ্ঠানে উঠলে সেলিম আল দীন বলতেন ‘এখানে বসে আছেন জীবনানন্দের পর বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মোহাম্মদ রফিক।’ উপলব্ধির সঙ্গে উচ্চারণের এমন উদারতা তো খুব একটা দেখিনা আমাদের কালে।
আল মাহমুদের ‘ধীরে খাও অজগরী ‘ নভেলেটের কথা বলতেন খুব। আমার সেটা তেমন ভাল না লাগায় বললেন, “ভাটিবাংলার বুকের ধ্বনি শুনতে হলে তোকে পড়তে হবে মাহমুদের ‘নিশিন্দা নারী’ও”। আবদুল মান্নান সৈয়দের নজরুল নিয়ে প্রবন্ধ ‘উড়নচণ্ডী কবিনটেশ: চিত্রকল্প তাঁর’ এর বিমুগ্ধ পাঠক ছিলেন। শব্দের প্রপাত তাঁর নিমজ্জনের বড় জায়গা ছিল কিন্তু তাই বলে নিজের শেষপর্বের স্মরণীয় লেখা ‘নিমজ্জন’-এ শব্দসজ্জাই নিরঙ্কুশ নয়, রক্তের দাগও সমান সত্য। নিজ গ্রাম ফেনীর সেনেরখিল আর দূরের রুয়ান্ডার গণহত্যাকে অভাবিত দক্ষতায় একীভূত করে জাজ্বল্য করেছেন সেথায়। ‘ঢাকা থিয়েটার’ তাঁর প্রাণ। বলতেন ‘বাচ্চু দেখাল সংলাপ-বিরল আমার বর্ণনার রাজ্যপাট কেমন করে মঞ্চসফল করা যেতে পারে।’
না, সেলিম আল দীনের সঙ্গে আমার অন্য বন্ধুর মতো গভীর যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। এর একটা বড় কারণ, তাঁর সামনে ভক্তের আসনে বসে বাক্যালাপে মন সায় দেয়নি কখনও কেন যেন বরং শামীম রেজা, মাহবুব মোর্শেদ বা সোহেল হাসান গালিব ভাইয়ের মতো আমার জাবিয়ান জ্যেষ্ঠরা কালেভদ্রে ক্যাম্পাসে এসে যখন তাঁর সঙ্গে সপ্রেম তর্কে মাততেন তখন সেটা বেশি উপভোগ্য মনে হতো। ভাবতাম, তাঁর লেখা আগাগোড়া পড়ে সব জেনেবুঝে নেই আগে, তারপর বসব বিশদে-বিস্তারে। কিন্তু জীবন এতটা বিশদ নয় তো, বিস্তারের সুযোগ দেয়না সব মানুষী অভিলাষকে।
তাই মৃত্যুর আগে শেষ জন্মদিনে তমস-নিবিড় ক্যাম্পাসে একলা হেঁটে চলা সেলিম আল দীনকে একটি শুভেচ্ছা-ফুল তুলে দেয়াই হয় আমার শেষ দেখার প্রহর। দেখা শেষ হয়ে আসে, মানুষের মৃত্যু ঘটে তবে সেই সেলিম আল দীনকে কি কখনই ‘বিদায়’ বলা যায়; ফুলকে যিনি ‘ফুল’ না বলে ‘কুসুম’ সম্বোধন করতেন! ‘বেলাশেষে ফুলের পাপড়ি ঝরিয়া পড়ে’ কিন্তু কুসুমে কুসুমে সেলিম আল দীনের মতো মায়া-কারিগরের চরণচিহ্ন তো চিরটি কাল বহিয়া চলে।