Skip to content

বাঙালি সংস্কৃতিচর্চায় মহীয়সী নারী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা

গ্রাম থিয়েটার পত্রিকা – ৩৭ বর্ষ

আশ্বিন-কার্তিক ১৪২৬
OCTOBER 2019​

মুতাসিম বিল্লাহ নাসির
‘যাদের সাথে পরিচয়, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব আছে সবাই যে যার মতো করে আমার কাছ থেকে যতটুকু পেরেছে আদায় করে নিয়েছে শুধু একজন ছাড়া।’ মৃত্যুর কিছুদিন আগে সেলিম আল দীন যাকে উদ্দেশ্য করে এই উক্তিটি করেছেন, তিনি হলেন বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা। ডাকনাম পারুল। মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার তালুকনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়, তিনিই প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের একান্ত সহধর্মিনী। বাবা মোকসেদ আলী খান, করটিয়া সা’দত কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। বাবার বাঙালি সংস্কৃতির শ্রদ্ধাভক্তিই বাঙালিয়ানার প্রভাব ফেলে তার জীবনে। করটিয়া আবেদা খানম গার্লস স্কুলের ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে এসএসসি শেষ করার পরে করটিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি ও বাংলাতে অনার্স করেন। তখন করটিয়া কলেজ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। প্রখ্যাত নাট্যকার সেলিম আল দীনও একই কলেজে বাংলায় অনার্স করেন। তখন থেকেই তাঁর সাথে পরিচয় এবং শেষে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। কর্মজীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষিকা ছিলেন। বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ ও বিকাশ এবং বিশ্ব দরবারে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় সন্ধানে তাঁর রয়েছে নীরব ভূমিকা। তাঁর স্বপ্ন ছিল সেলিম আল দীন বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্ব দরবারে পরিচিতি ঘটাবেন যা তার সাথে কথা বলে জানা যায়। ‘আমি সেলিম আল দীনকে নিয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসী ছিলাম যে, সে অনেক বড়ো মাপের একজন ব্যক্তিত্ব। আমার স্বপ্ন ছিল সে রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্ব দরবারে বাঙালির সম্মান কুড়িয়ে আনবে। তাই আমি আমার স্বপ্নের কথা সেলিম আল দীনকে সর্বদা বলতাম ও তাকে লিখতে উৎসাহিত করতাম।’

অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ৬ পেপার শেষ হওয়ার সময়ে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধ তাঁর স্মৃতিতে চির জাগরুক ছিল। তাঁর ভাষ্যে, স্টপ জেনোসাইড দেখলে মনে হয় যেন সেখানে আমিই আমার প্রতিচ্ছবি দেখছি। স্বপ্ন ছিল মুক্তিযোদ্ধরা দেশ স্বাধীন করবে মানুষকে মুক্তি দিবে। কিন্তু যখন দেখি আসল মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে পাওয়া ভার নকল মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে, তখন ভাবি এই স্বাধীনতা তো চাইনি। চাটুকারদের ভিড়ে আসল খুঁজে পাওয়াই আজ বড় সংকট। করটিয়া বাজারের ঝাড়–দার সুকানি পাগলার কথা আজো মনে পড়ে, সুকানি শুনলো পাকিস্তানি মিলিটারিরা বাজারে আগুন দেবে সব শেষ করে দেবে। সুকানি না পালিয়ে হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে বলল- দেখি আমার বাপ-দাদার বাজারে কোন শালারা আগুন দিবে, আমি বেঁচে থাকতে বাপ-দাদার ভিটেমাটি কিছুতেই ছাড়ব না। সেদিন সেই সুকানি পাগলা তাঁর জীবন দিয়েছেন এ দেশের জন্য, তাঁর জীবনে লালন করা সংস্কৃতির জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের পরে নারীরা পেশাগত ভাবে হয়ত নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে নারীদের উন্নয়ন এখনো পর্যন্ত ঘটেনি বলে মনে করতেন তিনি। ফ্যাশনের নামে নতুন প্রজন্ম ভুলে গিয়েছে তাদের বাঙালি সংস্কৃতির কথা। জিন্সের প্যান্ট, আর দোপাট্টা এটা আধুনিকতা না। চিন্তা চেতনায় আধুনিকতাই আসল আধুনিকতা যা এখনো বাঙালি নারীদের মধ্যে অনুপস্থিত। তিনি বলতেন, বাঙালি নারীদের পোশাকের আগের বর্ণনা ছিল ‘কুচবরণ কন্যা যে তার মেঘবরণ কেশ’। এখন মেয়েদের লম্বা চুলও খুঁজে পাওয়া যায়না, চুল কালোও থাকে না। মেক-আপের নামে তার আসল সৌন্দর্যও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।

স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর অভিব্যক্তি, বাংলাদেশ তার স্বকীয়তা নিয়ে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হোক। ভিনদেশি সংস্কৃতি যেন তার সংস্কৃতিকে গ্রাস না করে। আমরা অন্যদের সংস্কৃতি গ্রহণ করবো যেটা ভালো, কিন্তু যারা আমাদের সংস্কৃতির চর্চা করে না তাদের সংস্কৃতির চর্চা কেন আমরা করব? একই সাথে এটা ছিল প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনেরও দৃষ্টিভঙ্গি। যে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিলাম সেখানে যেন অন্য কোন ভাষা আমাদের ভাষাকে স্তদ্ধ না করে সেটাও দেখতে হবে।

তরুণদের নিয়েও তাঁর আকাঙ্খা-স্বপ্ন ছিল অনেক। যদিও তাঁর ক্ষোভ, বিদেশি ফিল্মের প্রভাবে নষ্ট হচ্ছে তরুণরা। হারিয়ে গেছে গ্রাম বাঙলার চিরচেনা সামাজিক বিচার ব্যবস্থা। ফলে যত্রতত্র ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে নারীরা। নারীদের মুক্তির কথা শুধু মুখে মুখে নয় সবার বাস্তব জীবনেও থাকতে হবে। পরিবার প্রথা ভেঙে দিয়ে নারী মুক্তি সম্ভব নয় তাই পরিবারের মধ্য থেকেই নারীকে মুক্তি দিতে হবে।

তরুণ প্রজন্মের প্রতি তাঁর পরামর্শ, ভিনদেশি সংস্কৃতির অনুকরণপ্রীতি থেকে বেরিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তায় চিন্তার উৎকর্ষের মাধ্যমে জনগণের মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। দলকে ভালো না বেশে দেশের জনগণকে ভালোবাসলেই সোনার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে।

গাছের সাথেও ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। তাই ছাদেই করেছিলেন বাগান। শত ব্যস্ততায়ও বাগান পরিচর্যা করতে ভুল করতেন না। ‘একদিন বাগানের কাছে না গেলে মনে হয় কতদিন যেন আমি ওদের পরিচর্যা করিনি’ এমনটাই মনে করতেন তিনি।

সেলিম আল দীনের স্বপ্নকে সত্যি করতে তিনি সদা তৎপর থাকতেন। কোথাও সেলিম আল দীনের লেখার কোন টুকরা কাগজ পেলে তা যত্নের সাথে সংরক্ষণ করতেন। যেন বাঙালি সংস্কৃতিকে আত্মমর্যাদা নিয়ে গৌরবের সাথে বাঁচিয়ে রাখার যে স্বপ্ন সেলিম আল দীন দেখতেন তা সত্যি হয়।
(পুনর্মুদ্রিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published.