স্মরণ
ইসরাত জেরিন
সময় স্রোতে চলে যেতে হয় আমাদের সবাইকে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, তবে এই চলে যাওয়াই হারিয়ে যাওয়া নয়। এই গভীর মায়া কুঞ্জে আমরা বেঁচে থাকি আমাদের আপন জনদের মানসপটে আর আমাদের কর্মের ভিতর দিয়ে। কাছের মানুষটার মৃত্যু আমাদের বিবর্ণ করে; তবুও মৃত্যু নামক বহমান এই কঠিন সত্যকে মেনে নিতে হয়।
গত ২২ ডিসেম্বর ২০২১ না ফেরার দেশে চলে গেলেন ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের গবেষক, লোক সংস্কৃতির ধারক কাজী সাইদ হোসেন দুলাল, তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যুতে শোকের ছায়া পড়েছে তার পরিবার আর তার আপনজনদের মাঝে। তিনি বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য এবং রাজশাহী পুঠিয়া থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। সংস্কৃতিমনা, আবেগী আর শিল্পবোধ সম্পন্ন এই মানুষটা আলিঙ্গন করেছিলেন হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের সাথে, জীবনের একটা দীর্ঘসময় কাজ করেছেন লোকনাট্য নিয়ে। সাধারণত যে জীবন চর্চায় বা যে অভ্যাসে আমরা অভ্যস্ত তাই প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, প্রথাবাহী স্রোতের বিপরীতে যে জীবন তা সহজ কোন জীবনগল্প নয়, এমন জীবনের সঙ্গে সবাই আলিঙ্গন করতে পারে না! এমনই এক শিল্পযোদ্ধা ছিলেন কাজী সাইদ হোসেন দুলাল, যেমন এই শিল্প ভান্ডারকে ভালোবেসে সমৃদ্ধ করেছেন তেমনই তিনি সিক্ত হয়েছেন গুনীজনদের ভালোবাসায়, এমনই এক শ্রদ্ধেয় গুনীজন বীরমুক্তিযোদ্ধা, নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু তাকে ‘নাটকের বাউল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন; নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের কাছে উপাধি পেয়েছিলেন ‘শিল্পবন্ধু’ নামে; যথার্থই নামকরণ, আসলেই তিনি বন্ধু ছিলেন এই বাংলা শিল্পসাহিত্যের, সুবিস্তৃত এই শিল্প ভান্ডারকে করেছেন আরও সমৃদ্ধ আর অলংকৃত; গেছেন এক বিস্তৃত গবেষনা ভান্ডার। আধুনিক নাটকের উপাদান হিসেবে কাজ করেছেন, করেছেন বিলুপ্তপ্রায় লোকনাট্যের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ! প্রায় ৩৫টি লোকপালার পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন যা রচিত হতো চারণ গায়কদের মুখে মুখে, কাজ করেছেন দেশের ৮৫টি লোকপালার সাথে, এই সম্পৃক্ততা তাকে এক অন্য রকম গবেষণার পথ দেখিয়েছে আর তিনি আমাদের দেখিয়েছেন বাংলা শিল্পভান্ডারের গভীর বিস্তৃতি। তাঁর সুবিস্তীর্ণ গবেষণা ভান্ডারের মাঝে রয়েছে মধ্যযুগের দুর্লভ সব পালাগান, বিলুপ্ত প্রায় যোগী গান, মিছিল গান, আঁটকুড়ে রাজার কেচ্ছা, সাধকরা মনসা মঙ্গলপালা, চণ্ডীমঙ্গল, লঙ্গীরগান, মাদার পীরের পালা আর কত কত পালা গানের ভান্ডার। তাঁর সংগ্রহ ভান্ডারে রয়েছে ‘পঞ্চরস’ পাণ্ডুলিপি যা সনাতনকালের দেব দেবীর চরিত্র নিয়ে রচিত, রয়েছে ‘ঈমান যাত্রাপালা’ যা রচিত হয়েছে মহররমের ঘটনা নিয়ে; এছাড়া ফিরিয়ে এনেছিলেন প্রায় হারাতে বসা পুঠিয়া অঞ্চলের জনপ্রিয় চলমান ‘লোকপালা মিছিল গান’ যা ১৯৫৬ সালের পর আর মঞ্চায়ন হয়নি, মিছিল গানে থাকতো শোষণ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
তাঁর গবেষণা ভান্ডার বার বার আমাদের সামনে তুলে এনেছে হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য, এই ছোট অনুচ্ছেদ লিখতে যেয়ে বার বার অনুভব করেছি একজন সাইদ হোসেন দুলালকে এত অল্প কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!
একজন মননশীল শিল্পযোদ্ধা চলে গেছেন চলে যাওয়ার নিয়মে না ফেরার দেশে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে কিন্তু আমাদের সাথে রয়েছেন সব সময় ভালোবাসা আর স্মৃতি হয়ে, তাঁর সুবিস্তীর্ণ গবেষণার প্রসার হোক আরও, তার কর্মজীবন দেখে উৎসাহিত হোক আরও অনেক তরুণ প্রাণ এমন শিল্পবোদ্ধা আরও জন্মাক আর এই মননশীল মানুষ দের এগিয়ে যাক আমাদের হাজার বছরের শিল্প সাহিত্য সময়ের নান্দনিকতায়; যেনো এই শিল্পযোদ্ধারা একই কথার সামিল হয়…. হাতের মুঠোয় হাজার বছর, আমরা চলেছি সামনে!