রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ নাট্যকার সেলিম আল দীনের- শিল্পসঙ্গী, নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ
সেলিম আল দীনের জন্মতিথির আয়োজনে আজ কী কী থাকছে?
বেশ কিছু আয়োজন থাকছে। সকালে ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটার ও অন্যান্য নাট্য সংগঠন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল দীনের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। নাট্য সংগঠন স্বপ্নদলও এ উপলক্ষে কর্মসূচি পালন করবে। গ্রাম থিয়েটারের অঙ্গ সংগঠনগুলোও জন্মতিথি উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের আয়োজনে র্যালি ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়াও সেলিম আল দীনের জয়ন্তী উপলক্ষে আগামী মাসে ঢাকা থিয়েটার থেকে নাট্য উৎসব করার পরিকল্পনা আছে।
তাঁর সঙ্গে অসংখ্য সময় কাটিয়েছেন আপনি। দু’জনের পরিচয়ের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল?
যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন ও মধুর ক্যান্টিনে রাজনৈতিক ও শিল্প আড্ডায় মেতে উঠতাম, সেলিম আল দীনও সেখানে প্রায়ই আসতেন। আরও আড্ডা দিতেন শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, রফিকুন নবী, সালাহউদ্দীন জাকী, হাশেম খান, শাহরিয়ার কবির, শহীদ কাদরী প্রমুখ। প্রথম পরিচয়ে খেয়াল করলাম সেলিম ছিলেন তুখোড় যৌবনদীপ্ত মানুষ। যে সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত। তবে সেলিমের সঙ্গে আমার শিল্পবন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুনের’ মধ্য দিয়ে। ১৯৭২ সালে তাঁর লেখা নাটকটি নির্দেশনা দিই।
শিল্পবন্ধুত্ব ও নাট্যযাত্রায় আপনাদের মূলমন্ত্র কী ছিল? সেটির প্রভাব পড়েছে কীভাবে?
আমাদের ভাবনা ছিল, ঔপনিবেশিক নাট্যরীতির অনুকরণে বাংলা নাটক নির্মিত হলে তা হবে আত্মঘাতী। স্বাধীন ও মুক্ত দেশে মানুষের নাট্যরীতি ও শিল্পবোধ তৈরি করা ছিল আমাদের মূল দায়িত্ব। সেটি প্রতিষ্ঠা করা এবং তার আলোকে বিশ্বনাটকে আমাদের স্থান নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট করা ছিল একটি বড় উদ্দেশ্য। আমরা বুঝলাম, বাংলা নাট্যরীতিকে আলাদাভাবে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে ঝঙ্কৃত হতে হবে। আর মনের মধ্যে লালন করতাম, ‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর, আমরা চলেছি সামনে।’ তার মানে, আমাদের নিজেদেরই রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ নাট্য ও শিল্প ইতিহাস এবং রুচি। পালাগান, কবিগান, মনসামঙ্গল, নটপালা, ভাসানযাত্রা- কত রকম ফর্ম, আঙ্গিক, কথনরীতি ও লেখ্যরীতি রয়েছে আমাদের। আমরা কেন অন্যের কাছ থেকে ধার করতে যাব? শিল্পরীতি ও সংস্কৃতি যদি ঔপনিবেশিক আদলেই গড়ে উঠতে থাকে, তাহলে কি সেটি স্বাধীন ও মুক্ত দেশের মানুষের স্বপ্নের কথা বলবে? তাই বাংলা নাটকের স্বকীয় অন্বেষণে আমরা কাজ করে গেছি।
নাট্যচর্চায় সেলিম আল দীন এখনও কেন প্রাসঙ্গিক?
রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা নাটকের বিষয়, ভাষা ও আঙ্গিকে সেলিম আল দীন সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে আবির্ভাবলগ্নেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলা নাটকের পরিচিত ও গতানুগতিক পথে হাঁটবেন না তিনি। তাই সূচনার সেলিম থেকে পরিণত সেলিম অনেক পরিবর্তিত, দশকে দশকে তিনি আবিস্কার করেছেন নাটকের নতুন নতুন পথ, কাঠামো ও চরিত্রসকল, প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার যাবতীয় অনুষঙ্গসমেত উপস্থিত হয়েছেন তার নাটকের পর নাটকে। মানুষ ও প্রকৃতি ছিল সেলিমের শিল্পের বিষয়। ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিকের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি ঔপনিবেশিক নাট্য ও শিল্পরীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন আপন শক্তি ও অহঙ্কারে। শুধু নাটক রচনা নয়! নিজস্ব শিল্পতত্ত্ব, ভাষারীতি নির্মাণ করে সেলিম নিজেকে করে তুললেন অননুকরণীয়। কঠিন শ্রমলব্ধ গবেষণায় মধ্যযুগের বাংলা নাটকের সূত্র ধরে তিনি প্রমাণ করলেন যে, বাংলা নাটক হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী। সেলিমের আরও শতকর্মের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে তিনি নাট্যশিক্ষার এক যুগান্তকারী ঘটনার জন্ম দেন। বাংলা ভাষার প্রথম ‘নাট্যকোষ’ রচনা তারই বিরল কীর্তি। তিনি সত্যিকার অর্থে একজন শেকড়সন্ধানী মানুষ ছিলেন। সেলিম আল দীন বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিতে।
(১৮ আগস্ট ২০১৯, দৈনিক সমকাল থেকে পুণঃপ্রকাশ)