আফসার আহমদ
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে বিভিন্ন থিয়েটার আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ঢাকা থিয়েটারের বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন এবং আরণ্যকের মুক্ত থিয়েটার আন্দোলন সেই সময়ে নাট্যচর্চায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে গ্রাম থিয়েটার এবং মুক্ত থিয়েটার আন্দোলন সারা দেশে ভালো নাটক মঞ্চায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এ কথা বলা যায় যে, এ নাট্য আন্দোলন আরও বেগবান করা প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশের ৪৩ বছরের থিয়েটারের ইতিহাসে নানা ধরনের নিরীক্ষাধর্মী থিয়েটার চর্চা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিকেন্দ্রিক একাডেমিক থিয়েটার চর্চা, পরিবেশবাদী থিয়েটার মুভমেন্ট, স্টুডিও থিয়েটার, রেপারটরি থিয়েটার এমনি আরও কিছু নিরীক্ষাধর্মী থিয়েটার চর্চার কথা বলা যায়। যদিও এর অনেকগুলোই, বিশেষ করে পরিবেশবাদী থিয়েটার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত টিকেনি। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয় যে, যা কিছু নিরীক্ষা হয়েছে তার অধিকাংশই রাজধানীকেন্দ্রিক। কখনো কখনো বিভাগীয় শহরগুলোতে এসব নিরীক্ষার প্রয়োগ ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণের কাছে এ নিরীক্ষার সুফল পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ফসল নাটক বাংলাদেশের সব স্তরের জনগণের কাছে একটি আধুনিক প্রপঞ্চ হিসেবে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাই বাংলাদেশের আধুনিক থিয়েটার চর্চার সুফলভোগী ঢাকাবাসী নাট্যদর্শক-সমগ্র দেশবাসী নয়।
মুক্তিযুদ্ধের পরই বাংলাদেশের নাট্যকার, নির্দেশক কিংবা নাট্যতাত্তি্বকগণ কর্তৃক বাঙালির নিজস্ব শিল্প নন্দনভাবনার অন্বেষণ প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উৎসারিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশজাত শিল্পভাবনার প্রেরণায় ইউরোপীয় নাট্যরীতির প্রচলন ভেঙে বেরিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করে নাট্যকার ও নির্দেশকরা। তাই বাঙালির নাট্যচর্চার যে অভিজ্ঞতা হাজার বছর ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তারই একটি আধুনিক রূপান্তর মুক্তিযুদ্ধের অব্যাহতির পরপরেই ঘটে যায়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর পর্বের বাংলাদেশের নাটকের রচনা, প্রয়োগ ও তাত্তি্বক বিনির্মাণ বিশ্বনাটকের ধারায় বিশেষভাবে উল্লেখের দাবিদার। এ কালপর্বের নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, নির্দেশক এবং তাত্তি্বকরা তাদের থিয়েটার অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঐতিহ্য ও আধুনিক বিশ্বের থিয়েটার ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশের নাটককে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তীকালের নাটক থেকে ভিন্নতর একটি স্থানে প্রতিষ্ঠা করলেন- ইতিহাস, সময় ও কাল বিচারে যা আধুনিক।
বাংলাদেশের নাটকের আরও একটি ধারাকে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এটিও সামগ্রিক অর্থে অর্জন। তা হলো সচেতনতা বৃদ্ধির নাটক, যা উন্নয়ন নাটক কিংবা ডেভেলপমেন্ট থিয়েটার। নাটকে সচেতনতা বৃদ্ধির কথাটি একালের নতুন আবিষ্কার নয়। আমরা দেখেছি ধ্রুপদী নাটক কিংবা যে কোনো মহৎ নাটকেই মানবজীবনের শুভবুদ্ধির কিংবা শুভের উদ্বোধন ঘটে। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্বে ভালো বিজয়ী হয়েছে সর্বকালে। এর পেছনে কাজ করে একটি ‘সিভিল কনসাসনেস’। এ ‘সিভিল কনসাসনেস’কে আলাদাভাবে দেখে আজকের বিশ্বে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নাটককে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখন এ ধারার নাটকের উদ্ভাবকরা নাটককে আর শুধু বিনোদনের মাধ্যম বিবেচনা করেন না। এখন সারা বিশ্বে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নাটকের প্রয়োগগত যে তাত্তি্বক বিনির্মাণ ঘটেছে তা উন্নয়ন থিয়েটার নামে পরিচিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশে এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলো নানা নামে যে থিয়েটার সংগঠন তৈরি করেছে তা কেবল নাটককে প্রচারের মাধ্যম রূপে গণ্য করছে। এটি নানা কারণে ব্যাপকতা পেয়েছে। তার একটি হলো থিয়েটার কর্মীকে পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠা দান। বাংলাদেশে এখন এনজিওভিত্তিক থিয়েটার সংগঠনের সংখ্যা অসংখ্য। সাধারণ জনগণকে নানা বিষয়ে সচেতন করার জন্য কিংবা কোনো বক্তব্য প্রচারের বাহন হিসেবে এখন উন্নয়ন থিয়েটার একটি নাট্য পরিভাষার মর্যাদা পেয়েছে। এখন সাইকোড্রামা সোসিওমেট্রিকস, ক্লিনিক্যাল থিয়েটার বিশেষ করে সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এনজিও সংগঠনের ডেভেলপমেন্ট থিয়েটার নাটকের শিল্প বিবেচনাকে বাদ দিয়ে নাটককে যেভাবে বক্তব্য প্রচারের বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে ব্যাপকতার দিক থেকে তা অবশ্যই বাংলাদেশে নাটকের নতুন ধারা রূপে চিহ্নিত। নতুন সময়ের প্রয়োজন ও অভিঘাতকে ধারণ করে এই সময়ের নাটক বিভিন্ন বিষয়াবলিকে সংঘবদ্ধ করেছে। এ ধারার নাট্যপ্রয়াসে দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশই প্রচারসর্বস্ব। তবে একথা বলা যায় যে, এসব নাটকের মাধ্যমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারীর অধিকার রক্ষায় এসব সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে একইসঙ্গে রাজনৈতিক অর্থায়ন ও অভীপ্সায় গঠিত এনজিওগুলো নাটকের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডকেও উসকে দিয়েছে। এর নিরসন হওয়া দেশের স্বার্থেই জরুরি। এ প্রসঙ্গে এ কথাটিও বিবেচনায় আনা দরকার যে আধুনিকতার অন্যতম মাপকাঠি সেক্যুলারিজম এবং যুক্তিবাদকে ধরা হলে বাংলাদেশে এখনো এর পূর্ণতর প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। যতটুকু সম্ভব হয়েছে তার অধিকাংশ কৃতিত্বের দাবিদার এদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা বিশেষ করে থিয়েটারকর্মীরা। থিয়েটারকর্মীরা সংঘবদ্ধভাবে নাটকের মাধ্যমে ‘সেক্যুলারিজম’ এবং ‘সিভিল কনসাসনেস’ তৈরির চেষ্টায় ব্রতী রয়েছেন। থিয়েটারের এসব কাজ আধুনিক সময় ও প্রয়োজনকে স্পর্শ করারই চেষ্টা মাত্র।
বাংলাদেশের নাটকের আধুনিক অভিযাত্রার অন্যতম নিয়ামক এদেশের গ্রুপ থিয়েটার সংগঠনগুলো। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার সংগঠনগুলো দলীয় আদর্শ ও উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র থেকেছে। এসব নাট্যদলকর্মীদের প্রকাশ্য কিংবা প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস রয়েছে। তাই তারা নাট্যচর্চার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার ঘোষণা করে। দেশীয় ঐতিহ্য কিংবা শেকড়সংলগ্ন সংস্কৃৃতির প্রতি প্রবল টান থেকেই তারা নাট্যচর্চায় নিজেদের নিবেদিত করে। যদিও বর্তমানে মিডিয়া ও টেকনোলজির ব্যাপক প্রসারের কারণে গ্রুপ থিয়েটারের কমিটমেন্ট শিথিল হয়ে আসছে।
এই পরিবর্তন শুধু বাংলাদেশেই ঘটছে না সমগ্র বিশ্বনাট্যচর্চার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারগুলো নাটকের সামগ্রিক অগ্রগতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপাদান জনসংস্কৃতির সঙ্গে নাট্যকর্মী এবং সিভিল সোসাইটির দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। এটি বাংলা নাটকের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমরা জানি যে আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মানেই জনগণের সংস্কৃৃতিকে নিম্ন সংস্কৃৃতি রূপে গণ্য করে দূরে সরিয়ে রাখা। সাধারণ মানুষের সংস্কৃৃতির সঙ্গে উচ্চশ্রেণির সংস্কৃৃতির বিভাজন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কালে ছিল। কিন্তু এই বিভাজনকে ১৯৭৬ সালে একটি টার্ম হিসেবে নিয়ে এলেন নৃবিজ্ঞানী এডোয়ার্ড টি. হল তার বিয়ণ্ড কালচার গ্রন্থে। আধুনিককালে এসে সাধারণ মানুষের সংস্কৃৃতির সঙ্গে আধুনিক মানুষের সংস্কৃৃতির তাত্তি্বক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিভাজন তৈরি হয়েছে। আর এভাবেই সমাজে ‘উচ্চ সংস্কৃৃতি’ ও ‘নিম্ন সংস্কৃৃতি’ এই শব্দবন্ধ চালু হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালের নাট্যচর্চায় আধুনিক মানেই উচ্চ সংস্কৃৃতি এ ধারণাটির বর্জন ঘটেছে গ্রুপ থিয়েটারের প্রচেষ্টায়। আধুনিকতা এবং আধুনিক শিল্পভাবনাকে ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গীকরণ করেই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালের বাংলা নাটকের তাত্তি্বক বিনির্মাণ ঘটেছে। অর্থাৎ লোকনাটকের উপাদানের সমন্বয় ঘটিয়ে আধুনিক নাট্যভাবনার ভিন্নতর উপস্থাপন ঘটেছে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায়। এই নাট্যরীতি হাজার বছর ধরে চর্চিত বর্ণনাত্দক বাংলা নাট্যাভিনয় রীতি। এই রীতিটিই আমাদের নাটককে স্বতন্ত্র ও মহিমান্বিত করেছে বিশ্বনাটকের ধারায়। এখন অনেকেই উপেক্ষা করেন কিন্তু একটা সময় আসবে যখন বাংলাদেশ গর্ব করবে তার বর্ণনাত্দক নাট্যরীতির পরিচয় দিয়ে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। কারণ পৃথিবীর বহু দেশেই তার জাতীয় নাট্যরীতি আছে। যেমন জাপানের নো, কাবুকি, চিনের চাইনিজ অপেরা, পঞ্চাঙ্ক রীতির ইউরোপীয় নাটক, গ্রিক নাটক- বললেই রীতিটি চেনা যায়। কিন্তু বাঙালির জাতীয় নাট্যরীতি কি প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর নেই। তবে আমাদের জাতীয় নাট্য আঙ্গিক কোনটা? আমি স্পষ্টভাবেই বলতে চাই তা হলো বাংলাদেশের বর্ণনাত্দক নাট্যরীতি যা হাজার বছর ধরে চর্চিত হয়ে এসেছে এই ভূখণ্ডে। রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেছিলেন বাংলার পাচালি, পালা, যাত্রাসহ ঐতিহ্যবাহী নাটকের শৈলীর আধুনিকীকরণ ঘটাতে।
তার নাটকে তাই (দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে) ইউরোপীয় অঙ্ক বিভাজন রীতি নেই। তিনি চেষ্টা করেছিলেন বর্ণনাত্দক পালা পাচালির আলোকে বাংলা নাটকের আঙ্গিক নির্মাণ করতে। কিন্তু সেই ধারাটি পরবর্তীকালে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়নি। বাংলার নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক বিকাশের পথে কালে কালে বাধা এসেছে বারবার। বারবারই উচ্চ সংস্কৃতির অভিজাত মানুষেরা এই রীতিটাকে দমিয়ে রেখেছে নিম্নশ্রেণির মানুষের সংস্কৃৃতি বলে। আসলে তারা এক বিশাল বঙ্গীয় জনপদের মানুষদের নিম্নশ্রেণির বলে উপেক্ষা করেছে। আর এজন্যই আচার্য ভরত তার নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে সেই সময়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় বঙ্গীয় নাট্যরীতির নামটিই উল্লেখ করলেন তার কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করলেন না। এই ভূখণ্ড বারবারই পরাধীন থেকেছে। নিজেদের ভাষায় শিল্পসাহিত্য চর্চা করারও স্বাধীনতা এই জনগোষ্ঠী পায়নি। চর্যাপদের কবিরা পাহাড়ে অরণ্যে লুকিয়ে বাংলা ভাষায় কবিতা গান রচনার চেষ্টা করেছেন। চর্যাপদের একটি কবিতায় একজন নৃত্যশিল্পীর উল্লেখ রয়েছ। স্পষ্টতই সে অনার্য এবং নিম্নশ্রেণির। কিন্তু নৃত্যকলায় অসাধারণ পারদর্শী এই শিল্পী নিজের শরীরের ভর শরীরে রেখে পদ্মফুলের পাপড়ির ওপর নাচতে পারেন বলে চর্যার কবি উল্লেখ করেছেন। এই পারদর্শিতা যে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর উন্নত সংস্কৃৃতি না থাকলে সম্ভব নয় তা স্পষ্ট। কিন্তু তাও অভিজাত সংস্কৃৃতির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এভাবে উপেক্ষিত হতে হতে এক সময় অবলুপ্ত হয়েছে বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতি ও সংস্কৃৃতি। অথচ আর্যরাই অনার্য শিবকে নাট্যদেবতা রূপে গ্রহণ করেছিল।
আর্যীয়করণের আগে থেকেই বঙ্গীয় ভূখণ্ডে নাট্যকলার যে বিকাশ ঘটেছে তারই প্রমাণ ভরতনাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে রয়েছে। এসব নাট্যের বিকাশ ও পরিপুষ্টি ঘটেছে গণসংস্কৃৃতিকে গ্রহণ করে। এভাবে যে নাট্যরীতি সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে তাই জাতীয় নাট্য আঙ্গিক এবং তা নিঃসন্দেহে বর্ণনাত্দক নাট্যরীতি। এই নাট্যের শিল্পরস নিষ্পত্তির জন্য ইউরোপীয় শিল্পরীতি কিংবা অ্যারিস্টটলের তত্ত্বের কাছে হাত পাতার প্রয়োজন নেই। হাজার বছর ধরে বাঙালির যেমন নিজস্ব নাট্যরীতি ছিল তেমনি ছিল নিজস্ব নন্দনশাস্ত্র। সমগ্র ইউরোপ যেমন পোয়েটিকস অনুসরণে শিল্পতত্ত্ব বিচারে ব্রতী রয়েছে তেমনি সমগ্র বঙ্গীয় জনপদের শিল্প নন্দনশাস্ত্র হলো চৈতন্য শিষ্য শ্রীরূপগোস্বামী প্রণীত ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি এ কালে ব্যাপকভাবে পঠিত হওয়া প্রয়োজন। এই গ্রন্থদৃষ্টে এমত ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে সংস্কৃৃত কাব্য কিংবা নাট্যতত্ত্বের ভাবনা থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র শিল্পতত্ত্ব ছিল বাংলাদেশে। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ পরিবেশনায় এই শিল্পরীতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
এই দীর্ঘ অবতারণার কারণ হলো আমি বলতে চেয়েছি এই বর্ণনাত্দক বাংলা নাট্যরীতি আমাদের জাতীয় নাট্য আঙ্গিক। এর সঙ্গে জাতীয় সংস্কৃৃতির ঘনিষ্ঠ অন্বয় রয়েছে। নিম্ন কিংবা লোকসংস্কৃৃতি বলে যা উপেক্ষিত ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় তাই হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় সংস্কৃৃতি। আর তাই বাংলাদশে নিম্ন সংস্কৃৃতির ‘ফোক’ শব্দটি ঔপনিবেশিক ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর নাট্যকর্মীদের হাতে। লোক ঐতিহ্যের উপাদান-উপকরণ বাংলা নাটকের বিষয় ও আঙ্গিক নির্মাণ রীতিটাই বদলে দেয়। এই কালপর্বে এসে নাট্য বিষয়ে লোকগল্পের উপাদান ও সমকালীন বাস্ততাকে অঙ্গীকরণ করেই নাট্যরচনার নবধারা তৈরি হলো। নাটকের বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গিকেও বদল ঘটল। এই রচনারীতির প্রভাব পড়ল নাট্য মঞ্চায়নে। এর ফলে দীর্ঘকালের প্রসেনিয়াম ঘেরাটোপ থেকে বাংলাদেশের নাটকের মুক্তি ঘটল। মৌলিক নাট্য রচনায় সংলাপের গড়ন পাল্টে যেতে থাকল। নাট্য দর্শক এবং অভিনেতার যে সংযোগ হাজার বছর ধরে চালু ছিল আসরকেন্দ্রিক পরিবেশনায় তারই একটি নতুনতর নির্মাণ ঘটে বাংলাদেশের নাটকে। সংস্কৃৃতিকে বিভাজনের ভেদবুদ্ধিজাত উঁচু-নিচু সংস্কৃৃতির প্রায় বিলোপ ঘটেছে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায়। আর এই সংস্কৃৃতির বিভাজনরীতি থেকে বেরিয়ে এসেই আমাদের পূর্বপুরুষরা নির্মাণ করেছিলেন সংলাপ, বর্ণনা ও সংগীত- এই ত্রয়ীর সম্মিলনে বর্ণনাত্দক বাংলা নাট্যরীতি। দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর ধরে সংলাপ-প্রতিসংলাপের মধ্যদিয়ে যে ইউরোপীয় নাট্যরীতির বিকাশ ঘটেছে তার থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র উপস্থাপনা বর্ণনাত্দক বাংলা নাট্যরীতি। ঔপনিবেশিক শিল্পতত্ত্বের আলোকে যারা এই নাট্যরীতিকে নাকচ করে দিতে চান তাদের জন্য করুণা বোধ করা যায়। এই সংগীত, সংলাপ ও বর্ণনার ত্রয়ী শুধু সংলাপ-প্রতিসংলাপের ইউরোপীয়রীতি থেকেই নয়, সংস্কৃত শিল্পতত্ত্ব থেকেও বাংলাদেশের এই নাট্যরীতি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। এরিস্টটলের নির্দেশিত শিল্পরীতি অনুযায়ী এদেশের নাটক ঘটনার অনুকরণ করে না, জীবনের ব্যাখ্যা করে। বাঙালির নিজস্ব শিল্প নন্দনভাবনার আলোকে বাংলাদেশের নাট্য আঙ্গিকের এই নবতর বিনির্মাণ সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর। বিশ্বনাট্য দিবসে আমরা এই প্রত্যয়ে পৌঁছতে পারি যে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন তার নাটক, বিশেষ করে নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক বর্ণনাত্দক নাট্যরীতির পুনঃনির্মাণ। বাংলাদেশের নাট্যকাররা তাদের নাটকে সমগ্র দেশ এবং মানুষের আখ্যানকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার অনুকরণ না করে ‘লোকবৃত্তির’ অনুকরণ করেছেন কিন্তু তা সংস্কৃত শিল্পতত্ত্বের নিগঢ়ে আবদ্ধ থেকে নয়। বর্ণনা, সংগীত ও সংলাপ- এই ত্রয়ীর সম্মিলনে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের রূপকার সেলিম আল দীনের নাটক একটি জনপদের আখ্যান হয়ে উঠেছে। এ আখ্যান রচিত হয়েছে এদেশের ভূগোলে। এসব আখ্যানের মৌল প্রবণতা ছিল অসাম্প্রদায়িক এক শিল্পবাসনা। যার রাজনৈতিক রূপায়ণ ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। এই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মূল চেতনায় ফিরে আসার জন্য শিল্প-সংস্কৃৃতি, বিশেষ করে নাটক এবং নাট্যকর্মীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বনাট্য দিবসে আসুন আমরা সবাই নতুন যুগের আলোয় বাঙালির জাতীয় নাট্য আঙ্গিক বর্ণনাত্দক রীতিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরি। আমরা পৃথিবীকে দেখাই বাঙালি নাটকের ক্ষেত্রে পৃথিবীর কোনো জাতির চেয়েই খাটো নয়। বিশ্বনাট্যমঞ্চে ঝঙ্কৃত হোক বাংলা নাট্যের শাশ্বত সুর। (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে পুণঃপ্রকাশ)